শুরু হচ্ছে অমর একুশে বইমেলা। বাঙালির এই প্রাণের মেলায় পাঠক ও লেখককে একসূত্রে গাঁথতে চায় যমুনা টেলিভিশন। টিভির পর্দাজুড়ে রয়েছে বইমেলা ঘিরে নানা অনুষ্ঠান। পাশাপাশি, ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মেও থাকছে বই নিয়ে বিশেষ আয়োজন। সেই ধারাবাহিকতায় থাকছে বইমেলায় প্রকাশিত নতুন-পুরোনো বইয়ের রিভিউ বা পাঠকের প্রতিক্রিয়া।
আজ থাকছে ২০২৩ বইমেলায় প্রকাশিত লেখক মুরাদ কিবরিয়ার বই ‘নিনাদ’ নিয়ে আলোচনা। লিখেছেন মারদিয়া মমতাজ।
গল্পটা রশীদের। বিহ্বল রশীদ জীবনের না পাওয়াগুলোকে হারিয়ে অসুর হয়ে উঠতে গিয়েও অসমর্থ হয়। হুট করে ঘটিয়ে ফেলে দুটো দুর্ঘটনা কিংবা শুধুই ঘটনা, যেগুলোকে ভবিতব্যের অংশ হিসেবে মেনে নেয়াই যায়। রশীদের তখন গভীরে সাঁতার কাটা মাছের মতো অন্তরালে চলে যাবার সময় অথচ সে খুব সামাজিক থেকে যায় সমাজের মধ্যখানে।
অপরাধ নিয়ে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি যাই হোক না কেন, অপরাধীর মনস্তত্ত্ব ও তার ধারাবাহিকতা নিয়ে আপনি দ্বিধায় পড়ে যাবেন, যখন রশীদের সঙ্গে আপনিও হেঁটে বেড়াবেন জীবনের প্রতিটি পৃষ্ঠায়। আপনি যদি মানুষের মনস্তাত্ত্বিক জগত নিয়ে আগ্রহী হন, যদি ভাবেন বাংলাদেশের মাটিতে আপনার কোনো না কোনো শেকড় গ্রথিত আছে, তবে আপনার ‘নিনাদ’ পড়া উচিত।
গল্পের নায়ক রশীদের সঙ্গে লেখক মুরাদ কিবরিয়ার হয়তো নিজের জীবনের একফোঁটা মিল নেই। তবু লিখেছেন তিনি অদ্ভুত ভাষায়। আপনার মনে হবে– আবছা সন্ধ্যেবেলায় রশীদ আপনার পাশে বসা। চায়ের কাপ ফুরিয়ে গেছে, সে নিজমুখে আপনাকে সমস্তটা বলে যাচ্ছে। আপনার গালে শুকিয়ে ওঠা অশ্রু জমা। বই পড়তে পড়তে শেষের দিকে যেখানে আপনার রোমাঞ্চিত হবার কথা, সেখানে আপনি আর রোমাঞ্চিত হতে পারছেন না। একজনের জীবনের গল্প শুনেই আপনি ক্লান্ত, বিধ্বস্ত।
লেখককে কোনোদিন সামনে পেলে জিজ্ঞেস করতাম, আপনি গল্পটা ভাবতে পেরেছিলেন কীভাবে? কীভাবে জানেন, আমারও আপনার ‘তার’ মতো হয়ে যেতে ইচ্ছে করে? আপাত নিস্পৃহ একটা মানুষের মতো হতে ইচ্ছে করে, যার ভেতরে ভিসুভিয়াসের দাউ দাউ অঙ্গার। কেন তাকে এমন শুকিয়ে যাওয়া লাভার মত কালো, শক্ত গ্রানাইট করে দিলেন? ওরকম একটা চরিত্রকে লিখে ফেলে আবার আপনি খান-ঘুমান কি করে!

একটা ব্যাপার লক্ষণীয়। লেখক মুরাদ কিবরিয়া একজন এমন মানুষকে কেন আমাদের সামনে নিয়ে এসেছেন, যার সব কাজ সমর্থন করা যাচ্ছে না? অথচ তার গল্পটার শেষটুকু পর্যন্ত সেই মানুষটির গল্পের মায়াও কাটিয়ে ওঠা যাচ্ছে না? রশীদ আসলে কে?
আমার, আপনার এমন অনেকগুলো লুকানো, গোপন, নিষিদ্ধ ও শাস্তিযোগ্য ইচ্ছে আছে; যেগুলোকে আমরা চেপে যাই ভদ্র সমাজের অংশ হয়ে ওঠার অজুহাত হিসেবে। রশীদ একবারও না ভেবে সেসব ইচ্ছের প্রতিফলন ঘটিয়েছে, এরপর ছুটে বেড়িয়েছে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায়। আমরা সম্ভবত এই জায়গায় এসে রশীদকে একটু ঈর্ষাও করেছি। বারবার দেখতে চেয়েছি, এই অবাধ্যতা আসলে কতদূর বিস্তৃত হতে পারে। নাকি এই এখনই চোরাবালিতে মুখ থুবড়ে পড়বে? খুব সম্ভব এই কৌতূহল বইয়ের শেষ অক্ষর পর্যন্ত আমাদের ধাবিত করেছে।
‘নিনাদ’ শেষ করে আচমকা আবিষ্কার করবেন– আপনি একা। রশীদ বলতে কেউ নেই। আপনি ও আপনার একাকিত্ব আছে শুধু। সেই একাকিত্বের কোনো রঙ নেই, আকার নেই। আছে শুধু গাঢ় অন্ধকারের বোধ। সেই বোধটুকু তলানিতেই পড়ে থাকবে।
নিনাদ- মুরাদ কিবরিয়া
প্রথম প্রকাশঃ অমর একুশে বইমেলা ২০২৩
প্রকাশনীঃ দুয়েন্দে পাবলিকেশন
পৃষ্ঠাসংখ্যাঃ ২৪৮
মূল্যঃ ৪৩০ টাকা
Leave a reply