ছবি: সংগৃহীত
মফিজুল ইসলাম⚫
বিশেষ শিক্ষা—এই শব্দ যুগলের সঙ্গে আমার আত্মিক বন্ধন বহু দিনের। কেবল পেশাগত দৃষ্টিকোণ থেকে নয়, বরং মননের গভীর থেকে উৎসারিত এক দায়বোধ, এক সমাজ-মানবিক প্রতিশ্রুতি থেকেই বিশেষ শিশুদের পাশে দাঁড়ানোর আকাঙ্ক্ষা আমার মধ্যে জন্ম নিয়েছে। ২০০০ সালের শুরুর দিক থেকে আজ পর্যন্ত পেছনে তাকালে দেখতে পাই, কত আনন্দ-বেদনার পদচিহ্ন পড়ে আছে এই দীর্ঘপথে। এই লেখায় আমি সেইসব অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণ তুলে ধরতে চাই, যাতে আমরা বুঝতে পারি—বাংলাদেশে বিশেষ শিক্ষার পথচলা কতটা গরিষ্ঠ, কতটা অসমাপ্ত এবং কতটা সম্ভাবনাময়।
অতীত: আইন ছিল, প্রয়োগ ছিল না
২০০১ সাল। বাংলাদেশে প্রতিবন্ধী কল্যাণ আইন প্রণীত হয়। আইনটি ছিল এক আশাব্যঞ্জক সূচনা। অথচ সেই আশার বাস্তবায়নে দেখা যায় সীমাহীন ব্যর্থতা। আইন কাগজে-কলমে রইল, কিন্তু বাস্তবতায় তার ছায়াও পড়ল না। ২০০৭ সালে জাতিসংঘের ইউএনসিআরপিডি চুক্তিতে স্বাক্ষরের মাধ্যমে এক নতুন দিগন্তের উন্মোচন ঘটে। এরই ধারাবাহিকতায় ২০১৩ সালে প্রণীত হয় ‘প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের অধিকার ও সুরক্ষা আইন’, যা অধিকতর মানবিক, অধিকতর অধিকারভিত্তিক।
কিন্তু এর পাশাপাশিই ২০১৩ সালেই পাশ হয় এনডিডি (নিউরো ডেভলপমেন্টাল ডিসঅ্যাবিলিটি) ট্রাস্ট আইন, যা মূলত একটি মেডিকেল মডেল-ভিত্তিক ধ্যানধারণা থেকে পরিচালিত। এই আইন একদিকে যতটা ভালো উদ্দেশ্য নিয়ে এসেছে, অন্যদিকে পূর্বোক্ত অধিকারে ভিত্তিক আইনটির সঙ্গে এক প্রকার সাংঘর্ষিক হয়ে ওঠে। ফলে নীতিমালার মধ্যেই দ্বৈততা সৃষ্টি হয়।
২০১৩ সালেই শুরু হয় প্রতিবন্ধী শনাক্তকরণ জরিপ। কিন্তু এর গতি এতটাই শ্লথ যে, একে “কচ্ছপের গতি” বললেও অতিশয়োক্তি হবে না। জরিপে যথাযথভাবে ব্যানবেইস বা জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোকে অন্তর্ভুক্ত না করায় এর পরিসর যথেষ্ট হয়নি। ফলে আমাদের হাতে নেই কোনো হালনাগাদ বা নির্ভরযোগ্য তথ্য, যা নীতিনির্ধারণে সহায়ক হতে পারত।
বর্তমান: আশার আলো, বাস্তবতার ছায়া
বিগত সরকারগুলোর মধ্যে কিছু কিছু সরকার বিশেষ শিশুদের বিষয়ে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। বিশেষ করে অটিজমকে কেন্দ্র করে নীতিগত উচ্চারণ ও মিডিয়াকেন্দ্রিক আলোচনার যেন বন্যা বইয়ে দেওয়া হয়। কিন্তু এই আগ্রহ কতটা প্রকৃত চাহিদার প্রতি সংবেদনশীল ছিল, আর কতটা লোকদেখানো—তা প্রশ্নসাপেক্ষ।
আক্ষরিক অর্থেই ‘ব্যাঙের ছাতার মতো’ অটিজম স্কুল গড়ে উঠতে থাকে। এমনকি এমন ঘটনাও ঘটেছে যেখানে স্কুলে একজনও অটিস্টিক শিক্ষার্থী নেই, অথচ নাম রাখা হয়েছে “অটিস্টিক বিদ্যালয়”! অনেকে তো ‘অটিজম’ শব্দটির বানান পর্যন্ত জানেন না, অথচ দাবি করেন বিশেষ শিক্ষা উদ্যোক্তা হিসেবে। এটি আমাদের সমাজের এক আত্মসর্বস্ব, সুযোগসন্ধানী প্রবণতার নগ্ন প্রতিচ্ছবি।
২০১৯ সালে প্রতিবন্ধীদের বিশেষ শিক্ষা নীতিমালা প্রণীত হলে—যার উদ্দেশ্য ছিল শিক্ষার গুণগত মান নিশ্চিত করা—অনেকেই সরকারি বেতন-ভাতা প্রাপ্তির আশায় বিশেষ বিদ্যালয় খুলতে ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিছু অসাধু চক্র মানুষকে ‘বিশেষ শিক্ষক’ বানিয়ে ৩ থেকে ৭ লক্ষ টাকা পর্যন্ত আদায় করে নেয়। অনেকেই বিশেষ কোনো প্রশিক্ষণ ছাড়াই নামমাত্র সার্টিফিকেট অর্জন করে শিক্ষকের চেয়ারে বসেছেন।
আজ অনেক শিক্ষক পথে আন্দোলন করছে। কেউ বিএসএড করেছে, কেউ করছে—সবই সরকারি চাকরি ও সম্মানজনক বেতনের আশায়। অথচ অনেক প্রতিষ্ঠান প্রধান নিজের চেয়ার নিরাপদ রাখতেই নিজ প্রতিষ্ঠানকে সরকারি তালিকাভুক্ত করেননি। আবার অনেকে দেশজুড়ে শাখা খুলে এক প্রকার ব্যবসায়ী-চরিত্রে রূপান্তরিত হয়েছেন। কেউ আবার মিডিয়ার সামনে দাঁড়িয়ে অতিদরদী হয়ে উঠেছেন, কিন্তু বাস্তবে কার্যত ফাঁকা।
ভবিষ্যৎ: আশা, সংশয় ও করণীয়
এই সকল জটিলতার পরও, আমাদের সামনে সম্ভাবনার দ্বার খোলা আছে। তবে এই ভবিষ্যৎ গঠনের পথে কয়েকটি জরুরি করণীয় আছে:
১. আইনের সঠিক বাস্তবায়ন
২০১৩ সালের অধিকার ও সুরক্ষা আইন এবং এনডিডি ট্রাস্ট আইন—এই দুইয়ের মাঝে সমন্বয় আনা আবশ্যক। একইসঙ্গে, মাঠপর্যায়ে সঠিক প্রয়োগ ও পর্যবেক্ষণের ব্যবস্থা থাকা চাই।
২. প্রশিক্ষণ ও সনদায়নের মানোন্নয়ন
বিশেষ শিক্ষক বা থেরাপিস্ট হতে হলে সুনির্দিষ্ট প্রশিক্ষণ, পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়ন প্রক্রিয়ার ভেতর দিয়ে যেতে হবে। বিএসএড যেন কেবল সার্টিফিকেট অর্জনের মাধ্যমে সরকারি বেতন পাওয়ার হাতিয়ার না হয়।
৩. তথ্যভাণ্ডার গঠন ও জরিপের আধুনিকায়ন
প্রতিবন্ধী শিশুদের সঠিক সংখ্যা ও চাহিদা নিরূপণ জরুরি। এ জন্য একটি আধুনিক তথ্যভাণ্ডার গঠন, যেখানে ব্যানবেইস ও জাতীয় পরিসংখ্যান ব্যুরোকে সম্পৃক্ত করতে হবে।
৪. শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সক্রিয় ভূমিকা
আজও বিশেষ শিক্ষা বা থেরাপির বিষয়গুলো সমাজকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের ওপরই নির্ভরশীল। অথচ বাস্তবতায় শিক্ষা ও স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়কেই এই দায়িত্বের বড় অংশ গ্রহণ করতে হবে।
৫. পেশাগত মর্যাদা ও সহমর্মিতা
থেরাপিস্ট এবং বিশেষ শিক্ষক—দুই পক্ষই যদি নিজ নিজ গুরুত্বকে বোঝে এবং একে অপরকে সম্মান করে, তাহলে শিশুর জন্য সার্বিক সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব। নিজেদের ‘বেস্ট’ মনে করার প্রবণতা নয়, বরং সম্মিলিত প্রচেষ্টা চাই।
শেষ কথা
বিশেষ শিক্ষা একটি সেবামূলক ক্ষেত্র, ব্যবসা নয়। এটি একান্তই নিষ্ঠা, ভালোবাসা ও মানবিক দায়বদ্ধতার প্রতিফলন। কেউ যদি একে ব্যবসা, পলিটিক্স বা সুবিধা অর্জনের মাধ্যম বানাতে চায়, তাহলে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় শিশুটি—যার চোখে আমাদের সমাজের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে।
এই সেক্টরের শিক্ষকরা আজ হীনমন্যতায় ভোগেন, কারণ তারা অবদান রাখার পরও তার মূল্যায়ন পাচ্ছেন না। অভিভাবকরা ভবিষ্যতের পুনর্বাসন নিয়ে উদ্বিগ্ন, কারণ তারা জানেন না—সন্তানটি সমাজে কীভাবে নিজের জায়গা করে নেবে।
সত্যিকার পরিবর্তন তখনই আসবে, যখন আমরা সবাই—নীতিনির্ধারক থেকে মাঠকর্মী, শিক্ষক থেকে থেরাপিস্ট, অভিভাবক থেকে উদ্যোক্তা—একত্রিত হব একটি মানবিক লক্ষ্যে। সেই লক্ষ্য হলো—প্রতিটি বিশেষ শিশুর সম্মানজনক জীবন, অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ এবং একটি ভবিষ্যৎ যেখানে সুযোগ ও মর্যাদা সবার জন্য সমান।
লেখক : মফিজুল ইসলাম, এক্সিকিউটিভ ডিরেক্টর, মুনফ্লাওয়ার অটিজম ফাউন্ডেশন
Leave a reply