যুদ্ধের সময় নাগরিকদের করণীয়

|

তালহা বিন জসিম

যুদ্ধ একটি ভয়াবহ বাস্তবতা, যা সাধারণ মানুষের জীবনকে বিপন্ন করে তোলে। যুদ্ধ পরিস্থিতিতে কেবল নিরাপদ থাকা নয়, দায়িত্বশীল নাগরিক হিসেবে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করাও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। এ সময় নিচের করণীয় বিষয়গুলো সকল নাগরিকের জানা উচিত:

নিরাপত্তা নিশ্চিত করা

নিজের ও পরিবারের নিরাপত্তা সবার আগে। যুদ্ধ শুরু হলে অথবা সংঘাতের আশঙ্কা দেখা দিলে দ্রুত সরকারি নির্দেশনা অনুযায়ী আশ্রয়কেন্দ্রে বা পূর্বনির্ধারিত নিরাপদ স্থানে চলে যান। আগে থেকেই আপনার এলাকার বাঙ্কার বা নিরাপদ আশ্রয়স্থলগুলোর অবস্থান জেনে রাখুন। যুদ্ধক্ষেত্র বা সীমান্তবর্তী এলাকায় অবস্থান করলে, সম্ভাব্য ঝুঁকি বিবেচনায় নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে নেওয়ার উদ্যোগ নিন।

সরকারি নির্দেশনা মেনে চলা

প্রশাসন, সেনাবাহিনী ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংস্থার পক্ষ থেকে প্রদত্ত নির্দেশনা কঠোরভাবে অনুসরণ করুন। কারফিউ, চলাচল নিষেধাজ্ঞা, খাদ্য ও চিকিৎসা সরবরাহ বিষয়ক নির্দেশনার ব্যত্যয় ঘটালে জীবনের ঝুঁকি তৈরি হতে পারে। যেমন বিমান হামলা হলে সাইরেন শুনে আশ্রয়কেন্দ্রে চলে যাওয়া, ব্ল্যাকআউটের নির্দেশনা মেনে চলা। গুজব নয়, কেবলমাত্র সরকার ঘোষিত তথ্য অনুসরণ করুন।

জরুরি প্রস্তুতি ও পরিকল্পনা

যুদ্ধ শুরু হওয়ার আগেই একটি ‘জরুরি ব্যাগ’ প্রস্তুত করে রাখুন যাতে প্রয়োজনীয় খাবার, বিশুদ্ধ পানি, ওষুধ, গুরুত্বপূর্ণ কাগজপত্র, মোবাইল চার্জার ও টর্চলাইট, রেডিও, রেইনকোট, ফার্স্ট এইড বক্স, বাঁশি থাকে। প্রতিটি ব্যাগে নিজ নিজ পরিচয় লিখে রাখুন। পরিবারে সবার সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট ইভাকুয়েশন পরিকল্পনা শেয়ার করুন—যেমন কোথা দিয়ে বের হবেন, কোথায় একত্র হবেন, কোথায় জরুরি ব্যাগ রাখা আছে ইত্যাদি। বছরে অন্তত একবার এর মহড়া করুন।

জরুরি অ্যালার্মের সময় করণীয়

যুদ্ধের সময় কখনও জরুরি অ্যালার্ম বাজানো হতে পারে। এ সময় সকল কাজ বন্ধ করে দ্রুত নির্দেশনা মেনে চলুন। এ সময় গ্যাস ও বিদ্যুতের লাইন বন্ধ করে নিরাপদে আশ্রয়ে চলে যাওয়া এবং সাথে সাথে রেডিও চালু করা ও নির্দেশনা মেনে চলা। এছাড়া প্রতিবেশীরা অ্যালার্ম শুনতে পেয়েছে কিনা তাদের খোঁজখবর নিন।

গোলাগুলির মধ্যে পড়ে গেলে

দ্রুত নিরাপদ আশ্রয়ে যাওয়ার চেষ্টা করুন। আহত হলে রক্তপাত বন্ধের চেষ্টা করুন। নিজেকে শান্ত রাখুন। মোবাইল সাইলেন্ট করুন যাতে শত্রুপক্ষ আপনার অবস্থান জানতে না পারে। কোন ভবনে আশ্রয় নিলে তার এক্সিট পয়েন্টগুলো পর্যবেক্ষণে রাখুন। রুমের সকল লাইট বন্ধ করে ঘর অন্ধকার করুন। দরজাগুলো ভালো করে বন্ধ করুন। এরপরও শত্রুর সামনে পড়ে গেলে সবটুকু শক্তি দিয়ে প্রতিরোধ করুন।

শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়লে

কোন সময় হয়তো শত্রুপক্ষের হাতে ধরা পড়ে যেতে পারেন। তখন নিজেকে শান্ত রাখুন। পরিচয়ের কাগজ দেখতে চাইলে তা দেখান। তাদের ছবি বা ভিডিও করা থেকে বিরত থাকুন। কথা বলার সময় হাত পকেটে না রেখে বাইরে রাখুন, হঠাৎ করে শরীর নড়াচড়া করবেন না, কোনো ধরনের ঝগড়ায় জড়াবেন না। খাবার সংরক্ষণ করুন। মার্জিত পোশাক পরুন।

কেমিকেল এজেন্ট ব্যবহার করলে

অনেক সময় শত্রুপক্ষ সলিড, লিকুইড ও গ্যাসীয় কেমিকেল এজেন্ট ব্যবহার করতে পারে। এরকম অবস্থায় পড়ে গেলে যতটা সম্ভব কেমিকেল এজেন্ট থেকে নিজেকে নিরাপদ রাখুন। এ সময় বাতাসের উল্টো দিকে থাকতে হবে। কোনো লিকুইড যেন শরীরে না লাগে তা খেয়াল রাখতে হবে। সম্ভব হলে গ্যাস মাস্ক ব্যবহার করুন, তা না হলে নাক-মুখে ভেজা কাপড় ব্যবহার করে শ্বাস নিন এবং দ্রুত দূষিত এলাকা থেকে বের হয়ে ভালোভাবে পরিষ্কার হোন। সকল জামাকাপড় কন্টামিনেটেড এলাকায় রেখে আসতে হবে, নিরাপদ স্থানে তা নিয়ে আসা যাবে না। এবং জামাকাপড় একটি প্লাস্টিক ব্যাগে ভরে ভালোভাবে সিল করে ফেলতে হবে।

প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ ও তা বাস্তবায়ন

সরকারের সিভিল ডিফেন্স প্রতিষ্ঠান থেকে যুদ্ধকালীন সময়ে করণীয় বিষয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়। যেমন—যুদ্ধকালীন নাগরিকদের সরিয়ে নেওয়া, আগুন লাগলে করণীয়, ব্ল্যাকআউটের সময় করণীয়, বিমান হামলার সময় সাইরেন সংকেতের ধারণা, আহতদের উদ্ধার ও প্রাথমিক চিকিৎসা প্রদান, গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো ক্যামোফ্লাজ করা ইত্যাদি। এসব প্রশিক্ষণ গ্রহণ করুন। প্রয়োজনে অস্ত্র চালনার প্রশিক্ষণও নিন।

আইন ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা

জাতীয় সংকটকালে সহনশীলতা ও শৃঙ্খলা বজায় রাখা জরুরি। কোনো ধরনের সহিংসতা, লুটপাট, উস্কানিমূলক বা প্রতিশোধমূলক কার্যকলাপে জড়াবেন না। সামরিক আইন বা জরুরি অবস্থার বিধি লঙ্ঘন করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ। নিজের আচরণে সচেতন ও দায়িত্বশীল থাকুন।

ভুল তথ্য ও গুজব থেকে দূরে থাকা

যুদ্ধের সময় ভুয়া খবর ও গুজব অত্যন্ত ক্ষতিকর হতে পারে। সোশ্যাল মিডিয়া বা হোয়াটসঅ্যাপ, ফেসবুক ইত্যাদিতে পাওয়া যেকোনো খবর শেয়ার করার আগে তার সত্যতা যাচাই করুন। সরকারি টিভি, রেডিও বা স্বীকৃত সংবাদ সংস্থা থেকেই তথ্য গ্রহণ করুন। অপ্রমাণিত সংবাদ প্রচার করে আতঙ্ক সৃষ্টি করবেন না।

শত্রুপক্ষকে কোনোভাবেই সহায়তা নয়

অজান্তেই শত্রুপক্ষের জন্য তথ্যদানে সহায়তা করে ফেলা বিপজ্জনক। তাই সেনাবাহিনী, কৌশলগত অবস্থা, সেনা গতিবিধি বা অস্ত্রসংক্রান্ত কোনো তথ্য সামাজিক মাধ্যমে বা অপরিচিত কারও সঙ্গে শেয়ার করবেন না। সন্দেহজনক কোনো ব্যক্তি বা কার্যকলাপ দেখলে দ্রুত আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে জানাবেন।

স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে মানবিক কাজে অংশগ্রহণ

নিজের নিরাপত্তা নিশ্চিত করে আশ্রয়কেন্দ্রে স্বেচ্ছাসেবক হিসেবে কাজ করুন। খাদ্য বিতরণ, রক্তদান, আহতদের সহায়তা, শিশু ও বৃদ্ধদের দেখভাল—এসব কাজে যুক্ত হতে পারেন। স্থানীয় স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের সঙ্গে সমন্বয় করে কাজ করাই সবচেয়ে কার্যকর। এছাড়া দেশের সিভিল ডিফেন্সের ওয়ার্ডেন বাহিনীতে যোগ দিন।

জাতীয় ঐক্য ও সহমর্মিতা বজায় রাখা

জাতীয় সংকটে বিভাজন নয়, একতা অপরিহার্য। জাতি, ধর্ম, অঞ্চল, ভাষা ইত্যাদি পরিচয়ের বাইরে গিয়ে একে অপরের পাশে দাঁড়ান। প্রতিবেশী, বিশেষ করে অসুস্থ, বৃদ্ধ বা প্রতিবন্ধীদের খোঁজ নিন। শিশুদের মানসিক সুরক্ষা দিন—আতঙ্ক নয়, সাহস দিন। একটি ঐক্যবদ্ধ জাতি যেকোনো শত্রুর বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ে তুলতে পারে।

খাবার ও পরিষ্কার পানি সংরক্ষণ

যুদ্ধ দীর্ঘস্থায়ী হলে সবচেয়ে বড় সংকট হয় খাবার ও পানীয় জলের। তাই খাবার ও পানির অপচয় বন্ধ করুন। বাড়ির আঙ্গিনায় শাকসবজি চাষের প্রস্তুতি রাখুন, বীজ সংরক্ষণ করুন। নদী বা পুকুরে মাছ ধরার ও সংরক্ষণের কৌশল জেনে রাখুন।

লেখক: স্টেশন অফিসার (মিডিয়া সেল), ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতর

/এসআইএন


সম্পর্কিত আরও পড়ুন




Leave a reply